মরমী সাধক হাসন রাজার জন্মবার্ষিকী

স্বনামধন্য লোকসঙ্গীত রচয়িতা ও সাধক হাসন রাজার জন্মবার্ষিকী আজ। আজও মানুষের কন্ঠে কন্ঠে হাসন রাজার গান হিসেবে ফিরে- ‘নেশা লাগিল রে’, ‘বাউলা কে বানাইলোরে’, ‘লোকে বলে হে বলে রে’, ‘মাটির পিঞ্জিরার মাঝে বন্দি’..অমূল্য এ গানগুলি। মরমী চারণ কবি হাসন রাজা ১৮৫৪ খৃসটাব্দ মোতাবেক ১২৬১ বঙ্গাব্দের  ৭ পৌষ বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলার লক্ষণশ্রী গ্রামে এক বিত্তবান জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। হাসন রাজার পূর্ব পুরুষ দক্ষিণ রাঢ় দেশ থেকে হিন্দু কায়স্থ রাজা বিজয় সিংহ এবং তার অন্যান্য ভাইদের সঙ্গে শত্রুতা এবং বিবাদের সূত্রপাত হলে শ্রীহট্ট জেলায় এসে কুলাউড়া নামক স্থানে বসতি গড়ে তোলেন। সেখানে কিছুদিন থাকার পর চলে আসেন ‘রামপাশা’য় এবং দেওয়ান বাবু ইসলাম ধর্মে দীক্ষালাভ করে বাবু খাঁ নাম গ্রহন করে পরবর্তীকালে সেই নামেই পরিচিতি লাভ করেন। দেওয়ান খাঁ’র কয়েক পুরুষ পরের বংশধর দেওয়ান আলী রেজা চৌধুরী তার জমিদারী রামপাশা থেকে স্থানান্তরিত করে নিয়ে আসেন সুনামগঞ্জের কাছে লক্ষণশ্রীতে। এই লক্ষণশ্রীতেই জন্ম গ্রহন করেছিলেন দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরী ওরফে হাসন রাজা। হাসন রাজার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তেমন কিছু ছিল না কিন্তু মনের দিক থেকে তিনি ছিলেন এক মরমী সাধক। এবং আধ্যাত্মিক পথের পথিক। শীতের সময় যখন গ্রামে গঞ্জে অন্যান্য পালাগানের সঙ্গে গাজী’র গীতের আসর বসত, হাসন রাজা সে খবর জানতে পারলে তার সকল প্রকার খরচ বহন করতেন হাসি মুখে। নিজেও প্রায় সময় এই সব পালাগানের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন।  নিজের সম্পত্তি হাসন রাজা নিজে দেখেশুনে রাখতে পারতেন না তাঁর কোমল স্বভাবের জন্য। সেজন্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার লোকসানের অন্ত ছিল না। ১৯২০ সালে সে সময়ে ভারতে নিযুক্ত বড় লাট চেমর্স ফোর্ড সিলেট ভ্রমণে এলে হাসন রাজা তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। হাসন রাজা সিলেটে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এস,ই স্কুল। এই স্কুলের মেধাবী ছাত্রদের আবাসন ও পড়াশুনার জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করেছিলেন । উত্তরকালে এই এম,ই স্কুলই পরিবর্তিত হয় জুবিলি ইংলিশ হাই স্কুল নামে। একসময় অভিনয়ও করতেন হাসন রাজা। কারণ তাঁর চেহারা ছিল খুবই সুন্দর এবং আকর্ষণীয়। তিনি অভিনয় করতেন পৌরাণিক নাটকে শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকায়। মধ্য বয়সে জমিদারী চালাতে গিয়ে তিনি বেশ ভোগ বিলাসী হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর কোন টাকা পয়সা, আরাম অথবা আনন্দের অভাব ছিল না। কিন্তু তারপর এক সময় আসল, যখন এসব আরাম ও আনন্দ তার নিকট অর্থহীন মনে হল। তিনি তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ত্যাগ করলেন। প্রতিষ্ঠা করেন বেশ কটি মসজিদ ও মন্দির। এবং নিজে শুরু করেন দরবেশি জীবনযাপন।তিনি সৃষ্টিকর্তা, জীবন-মৃত্যু এবং মানবপ্রেম সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করা শুরু করলেন। হাসন রাজা অসংখ্য গান লিখেছেন, অনেকের মতে সংখ্যায় তা প্রায় এক হাজার। ‘হাসন উদাস’ নামে তাঁর রচিত বই ১৯০৬ সালে প্রকাশিত হয়। বইটিতে ২০৬টি গান ছিল। তাঁর গানে হাসান নিজেকে ‘পাগল হাসন রাজা’ অথবা ‘পাগলা হাসন রাজা’ রূপে তুলে ধরেন। ‘হাসন রাজা সমগ্র’ নামে একখন্ড পুস্তকও (হাসন রাজার পরিপূর্ণ রচনা) প্রকাশিত হয়েছিল। বইটিতে ৫০০টি কবিতা ও গান ছিল। কিছু সংখ্যক গান কবি কর্তৃক হিন্দিতে লেখা হয়েছিল। সিলেটে হাসন রাজার গান সবসময় জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু অনতিবিলম্বে তা সমগ্র বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। ভারতের পশ্চিম বঙ্গে, কিছু প্রখ্যাত লোকশিল্পী হাছনের গানগুলিকে জনপ্রিয় করে তোলেন। শেষ জীবনে তিনি রীতিমত সংসারত্যাগী বৈরাগ্যব্রত অবলম্বন করেন এবং নিজের যাবতীয় সহায় সম্পত্তি বিভিন্ন জনহিতকর কাজে ও প্রতিষ্ঠানে দান করে দেন। হাসন রাজা অসাম্প্রদায়িক ও যেকোন রকম সংকীর্ণতার উর্ধ্বে ছিলেন। তাঁর চোখে সবাই ছিল সমান। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গির জন্য তিনি তৎকালীন সময়ে হিন্দু-মুসলমান সবার কাছে সমান প্রিয় ছিলেন । ১৯২২ খৃস্টাব্দ মোতাবেক ১৩২৯ বঙ্গাব্দের ২২ অগ্রহায়ণ এ মরমী সাধক ও চারণ কবি পরলোক গমন করেন। 

তথ্যসূত্র : ‘শত বাঙালীর জীবনকথা’, ‘নতুন বিশ্ব’,  ‘সংকলিত পাঠ্য বই’।

#লেখক: মোঃ ফেরদৌস আলম (২০১৪ সালে আঞ্চলিক দৈনিক অজানা বার্তা পত্রিকায় লেখাটি প্রকাশিত হয়।)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

জেরুজালেমের নবি যেরেমিয়া ও জলবায়ু সতর্কতা

শকুন ও সংস্কৃতির দ্বন্দ্ববিচার

একটি জাতীয়তাবাদী নাটিকা : বাংলা ও বালআমের গাধা