জেরুজালেমের নবি যেরেমিয়া ও জলবায়ু সতর্কতা

“যেরেমিয়ার কম্পিত কণ্ঠ থেকে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এল: প্রভু, প্রভু, তোমার অভিসম্পাত কি অবশেষে সত্য সত্যই নেমে এল?” বাঙালি কথাসাহিত্যিক সত্যেন সেন এক পর্যায়ে ইহুদি জাতির ইতিহাস নিয়ে বাইবেল নির্ভর দুটি উপন্যাস লিখেছেন। ‘অভিশপ্ত নগরী’ ও ‘পাপের সন্তান’ উপন্যাসে ইহুদি জাতির বিপর্যয় ও পুনর্গঠনের চেষ্টাকে লেখক বিশ্লেষণ করেছেন মনের মাধুরী মিশিয়ে। ব্যবিলনের সম্রাট নেবুচাঁদনেজারের আক্রমণে ইহুদি জাতি বিপর্যস্ত হবে এ ভবিষ্যদ্বাণী আগেই করেছিলেন নবি যেরেমিয়া। “যেরেমিয়া বলে উঠলেন: ধ্বংসের দূত শৃঙ্গনিনাদ করে উঠেছে। অভিশপ্ত নগরী, এইবার মহাসংহারের জন্য প্রস্তুত হও!” যেরেমিয়ার ভবিষ্যদ্বাণী ইহুদিরা অবহেলা করেছিল। যেরেমিয়াকে মেরে ফেলার চেষ্টাও করেছিল। একসময়ের জাতিসমূহের রাজধানী হিসেবে পরিচিত জেরুজালেম ঠিকই ধ্বংসের কবলে পড়ে। যেরেমিয়াকেও ছাড়তে হয় জেরুজালেম। 

ছবি: নেবুচাঁদনেজারের সেনাবাহিনী কর্তৃক জেরুজালেমে অগ্নিসংযোগ। 
circle of Juan de la Corte, ca. 1630-1660. Wikimedia
Retrieved from: https://www.thetorah.com/article/the-history-leading-up-to-the-destruction-of-judah
Image source: https://assets-global.website-files.com/5b8fd783bee52c8fb59b1fac/62eabace6ca96a679b4e35f6_The_Burningof_Jerusalem_20byNebuchadnezzar%2520Tisha%2520bav.jpeg

সত্যেন সেন যেরেমিয়ার ভবিষ্যদ্বাণীকে দেখেছেন ভিন্নভাবে। বাবিলদের হিংস্র আক্রমণ কি শুধুই যেরেমিয়ার ভবিষ্যদ্বাণীর ফল? বাবিল সেনাপতি বলেন: “আপনি এত দিন ধরে আপনার বাণীর মধ্য দিয়ে যিরূশালেমের অধিবাসীদের মনের মধ্যে নিরবচ্ছিন্নভাবে যে ভীতি, দ্বন্দ্ব ও নিরাশার মনোভাবের সৃষ্টি করে এসেছেন, তাতে আমরা লাভবান হয়েছি।” বাবিল সেনাপতির এমন অভিযোগে যেরেমিয়া বলেছেন: “আমি যা ভবিষ্যদ্বাণী করে আসছিলাম, সত্য সত্যই তা ফলেছে। কিন্তু তাই দিয়ে আপনাদের হাতের কলঙ্ক ঢাকা পড়ে না।” জলবায়ু প্রসঙ্গ লুকাতে চাওয়া অনেক রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানের মূখপাত্র ঠিক এভাবেই জলবায়ু নিয়ে উদ্বিগ্ন গবেষকদের দোষারোপ করে থাকে। কিন্তু তারা সতর্ক করছেন মাত্র। যদি যথাযথ কর্তৃপক্ষ সতর্ক না হয়, তাহলে ভবিষ্যদ্বাণীর অবকাশ থাকবে না। বনি ইসরাইলের নবি যেরেমিয়ার কথা ইহুদি, খ্রিস্টান ও কিছু ঐতিহাসিক উৎসে পাওয়া যায়। কুরআনে যেরেমিয়ার নাম না থাকলেও তার ব্যাপারে ইঙ্গিত আছে বলে মনে করা হয়। যাহোক, বিভিন্ন বর্ণনায় যেরেমিয়ার সম্পর্কে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যা পাওয়া যায় তা হলো ব্যবিলন সম্রাট নেবুচাঁদনেজার কর্তৃক জেরুজালেম আক্রমণ ও ধ্বংসের ব্যাপারে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। আমরা বাঙালি লেখক সত্যেন সেনের বিখ্যাত জোড় উপন্যাস ‘অভিশপ্ত নগরী’ ও ‘পাপের সন্তান’ পড়ে লেখকের কল্পনায় তৎকালীন জেরুজালেম ও ইহুদি সমাজের বর্ণনা পাই। খোদার হুকুম অমান্যকারী ইহুদিদের সতর্ককারী হিসেবে আবির্ভূত হন যেরেমিয়া। কিন্তু ইহুদিরা তাকে অবজ্ঞা করে দুষ্কৃতিতে মেতে থাকে সোৎসাহে। খোদা যেরেমিয়ার মাধ্যমে তাদের ধ্বংসের বাণী পাঠান। তারা নিজেদের দুর্দশার পূর্বাভাস অবহেলা করে বরং যেরেমিয়ার প্রতি নিপীড়ন শুরু করে। তাকে প্রাণে মেরে ফেলতে কুয়ায় নিক্ষেপ করা হয়। যেরেমিয়া অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। শীঘ্রই বাবিলদের আক্রমণ যেরেমিয়ার ভবিষ্যদ্বাণীকে দিনের আলোর মতো সত্য করে তোলে। যেরেমিয়ার কাহিনিতে আমরা দেখি ভবিষ্যদ্বাণীর কার্যকারীতা। 

ধর্মগ্রন্থোক্ত বিভিন্ন জাতির বিনাশের মাধ্যম ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ইতিহাসও এতে সাক্ষ্য দেয়। বন্যা, অতিবৃষ্টি, খরা, ভূমিকম্প, ঝড় ইত্যাদির মাধ্যমে ধ্বংস হয়েছে শত শক্তিমান জাতি। এছাড়া মহামারি, উপর্যুক্ত বহিরাক্রমণের কারণেও নিশ্চিহ্ন হয়েছে অনেক জাতি। যেসব যুগে নবি এসেছেন তারা সতর্ক করেছেন। নবি অর্থ সংবাদদাতা। ফার্সিতে পয়গম্বর। ইংরেজিতে প্রফেট। সবগুলোর অর্থই সংবাদদাতা, ভবিষ্যদ্বাণী দানকারী যদিও সাধারণ ভবিষ্যদ্বাণী থেকে নবিদের ভবিষ্যদ্বাণী ভিন্ন। তাদের সত্য প্রমাণিত ভবিষ্যদ্বাণীর বর্ণনা আমরা ধর্মগ্রন্থে পাই। পয়গম্বরগণ পরকাল সম্পর্কে বাণী দিয়েছেন যদিও তা বিচারের অবকাশ আমাদের মতো ইন্দ্রীয়বিলাসী মানুষের হয় না। তথাপি, ঐহিক ভবিষ্যদ্বাণী যে সত্য হয়েছে তার ঐতিহাসিক সাক্ষ্য পাওয়া যায়। নবিরা সৃষ্টিকর্তার উপাসনায় মানুষকে আহ্বান করতেন। সদাচারে উদ্বুদ্ধ করতেন। যুগের পর যুগ চেষ্টা করেও যখন তারা ব্যর্থ হতেন, তখন সৃষ্টিকর্তা তার জাতির প্রতি ‘গজব’ পাঠাতেন। অধিকাংশ গজবই ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগের আকারে। বন্যার আগাম খবর পেয়ে মানুষ বিশ্বাস করতো না। অন্য কোনো দুর্যোগও না। দুর্যোগের অপেক্ষায় তারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠতো। অনন্তর একদিন নেমে আসতো ধ্বংসলীলা। কখনো কখনো তারা দুর্যোগের আগেই নবিকে হত্যা করতো অন্ধ আক্রোশে। নিজেরা সমূলে নিশ্চিহ্ন হতো। এই নবিরা শুধুই আবহাওয়াবিদ ছিলেন না। সে দুর্যোগে মানুষের পরিবেশ দূষণ কোনো ভূমিকা রেখেছে কিনা তাও আমরা জানি না। 

সম্প্রতি (১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩) লিবিয়ায় আকস্মিক বন্যায় (ঘূর্ণিঝড় হারিকেন দানিয়েল) হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। বন্দরনগরী দারনা প্রায় মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। এর দু’দিন আগে (৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩) উত্তর আফ্রিকার আরেক দেশ মরক্কোয় শক্তিশালী ভূমিকম্পে কয়েক হাজার মানুষ মারা যায়। 

ধর্মে দুর্যোগের কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে মানুষের পাপাচারকে। নবিদের আগমনের ধারা বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগে। এরপরের দুর্যোগের কারণ বা ভবিষ্যদ্বাণী আর সেভাবে পাওয়া যায় না। মানব ইতিহাসের অন্যতম নিয়মিত ঘটনা যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত ছিল মানুষ। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুই যুদ্ধ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮) ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) শেষ হলে মানবজাতির হুশ ফেরে। পারমানবিক বিস্ফোরণের মতো আত্মবিধ্বংসী ঘটনা ঘটিয়ে মানুষ পরিবেশের প্রতি মনোযোগ দেয়। এরপরও যুদ্ধ হয়েছে। ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ গঠন করা হলে রাষ্ট্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করে। জলবায়ু পরিবর্তনকে বিশ্বের জন্য অন্যতম সংকট হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী উদ্বেগ ছিল প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষয় বা নিঃশেষকরণ নিয়ে। ১৯৪৯ সাল থেকে ধীরে ধীরে জলবায়ু নিয়ে উদ্বেগের ব্যাপ্তি বাড়তে থাকে। ১৯৭২ সালের ১৬ জুন সুইডেনের স্টকহোমে প্রথম ধরিত্রী সম্মেলন-ইউএনসিএইচই (জাতিসংঘ মানব পরিবেশ সম্মেলন) অনুষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘের উদ্যোগে বিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়সমূহ চিহ্নিত করতে শুরু করেন এবং রাষ্ট্রগুলোকে এর চূড়ান্ত প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক করতে থাকেন। সম্মেলনে ইউএনইপি (জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি) গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যদিও তাতে জলবায়ু পরিবর্তনের পরিবর্তে ক্ষুদ্র বিষয়সমূহ প্রাধান্য পায়। বিশেষ করে সম্পদ, পরিবেশ ও উন্নয়ন। ১৯৮৭ সালে ওজোন স্তর ক্ষয় সংক্রান্ত মন্ট্রিল প্রটোকল গৃহীত ও ১৯৮৯ সালে কার্যকর হয়। ১৯৮৮ সালে ইউএনইপি ও ডব্লিউএমও (বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা)-এর যৌথ প্রযোজনায় গঠিত হয় আইপিসিসি (আন্তরাষ্ট্রীয় জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সম্মেলন)। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় ধরিত্রী সম্মেলন-ইউএনসিইডি (জাতিসংঘ পরিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক সম্মেলন)। এখানেও গুরুত্ব পায় উন্নয়ন। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে উন্নয়নকে কতটুকু উৎসর্গ করা সমীচীন হবে-তাই হতে থাকে সব উদ্যোগের মূলকথা। গঠিত হয় ইউএনএফসিসিসি (জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন রূপরেখা সম্মেলন)। বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাস বৃদ্ধির বিপদজনক পরিবেশে মানব হস্তক্ষেপ রোধে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক উদ্যোগ। ১৯৯৫ সালের বার্লিন সম্মেলন থেকে কপ (পক্ষসমূহের সম্মেলন) অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে প্রায় প্রতি বছর। শিল্পোন্নত দেশগুলোর সামগ্রিক কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে কিয়োটো প্রটোকল গৃহীত হয়।* সাম্প্রতিক জলবায়ু সম্মেলনগুলো শেষে শিল্পায়ন যুগপূর্ব তাপমাত্রা থেকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধির সীমা নির্ধারণে সম্মত হয়েছে দেশগুলো। যদিও পরে যুক্তরাষ্ট্র এ সীমারেখা মেনে নিতে আপত্তি জানায়। কিয়োটো প্রটোকল নিয়ে আপত্তি জানায় চীন, ভারত, ব্রাজিলের মতো দেশগুলো। অর্থাৎ, কেউই উন্নয়নের এক চুল ছাড় দিতে রাজি নয়। 

নবিদের যুগে দুর্যোগের ভবিষ্যদ্বাণী আঞ্চলিক ভিত্তিতে ছিল বেশিরভাগ। বর্তমান জলবায়ু ঝুকিও আঞ্চলিক। কেউ অবশ্য বাদ যাবে না। কোথাও বেশি, কোথাও কম। আইপিসিসি নিয়মিত জলবায়ু বিষয়ক গবেষণা মূল্যায়ন করে প্রকাশ করে থাকে। বিশ্বের প্রায় সব দেশ এর সদস্য। বিশ্বের হাজার হাজার জলবায়ু বিষয়ক গবেষণা মূল্যায়নের জন্য এদের স্বেচ্ছাসেবী দল রয়েছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ঐকতান আনার চেষ্টা করছে আইপিসিসি। জলবায়ু ঝুকি মোকাবেলায় দু’টি পরিভাষা বেশি আলোচিত। অভ্যস্ত হওয়া ও হ্রাসকরণ। বিশ্বের দায়িত্বশীল দেশগুলো অভ্যস্ত হওয়ার প্রতি জোর দিয়ে থাকে। ঝুকি মোকাবেলায় বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি দেয়। দিনশেষে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ তা থেকে কতটুকু উপকৃত হয় তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। এর সিংহভাগ খরচ হয় এসব দেশের রাষ্ট্রযন্ত্রের তুঘলকি পরিকল্পনায়। আমি ব্যক্তিগতভাবে কপ-২৬ (গ্লাসগো সম্মেলন)-এর একটি প্রকাশনার পর্যালোচনা করে দেখেছি যেখানে ‘অভ্যস্ত হওয়া’ই তাদের বিষয়বস্তু। হ্রাসকরণের প্রতি তাদের কোনো মনোযোগ লক্ষ্য করা যায় না। হ্রাসকরণকে পুরোপুরি পাশ কাটিয়ে আসলে জলবায়ু ঝুকি মোকাবেলা করা যাবে না। প্রাথমিকভাবে রাশিয়ার মতো কিছু দেশ উপকৃত হবে বলে মনে করা হলেও দুর্যোগ বৈশ্বিক রূপ ধারণ করবে। আইপিসিসি রিপোর্টের সমালোচনাও প্রচুর। গবেষণা চয়নের অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া, পরিভাষার অস্পষ্টতা, বুদ্ধিবৃত্তিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব ইত্যাদি এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এটি মূল্যবোধ নিরপেক্ষ নয় বলে অভিযোগ রয়েছে। রয়েছে জবাবদিহিতার অভাব। আইপিসিসি ব্যুরোতে রয়েছে বিভিন্ন সরকারের প্রতিনিধিত্বের প্রমাণ যারা চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ রাখে গবেষক নির্বাচনে। 

নবি যেরেমিয়ার সময়েও মিথ্যা নবি দাবি করে অনেকে তার ভবিষ্যদ্বাণীর প্রতিবাদ করেছিল। শাসক ও স্বার্থগোষ্ঠীর মত প্রতিষ্ঠায় তারা তৎপর ছিলেন। কিন্তু শেষে যেরেমিয়ার ভবিষ্যদ্বাণীই সত্য হয়। নবিদের ভবিষ্যদ্বাণীর যুগ শেষ হলেও এ যুগে হয়তো জলবায়ু নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করার সুযোগটাই রয়েছে। সে যুগের মতো জ্ঞানপাপীরা জলবায়ু ঝুকির ব্যাপারে উদাসীন। সাধারণ মানুষের দূরদৃষ্টি কম। কালো মেঘ দেখে আমরা বুঝি বৃষ্টি হবে। উত্তরে মেঘ দেখে ভাবি ঝড় হবে। এখন আধুনিক যন্ত্রে আবহাওয়া বার্তা পাওয়া আরও সহজ হয়েছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। সাধারণ মানুষের ভাবনাটা দীর্ঘকালীন না হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনকে উপজীব্য করে যেসব সংগঠন গড়ে উঠেছে, তাদের ভূমিকা কতটা আশা জাগানিয়া?

রাষ্ট্রযন্ত্রের ভূমিকা তো বরাবরই হতাশাজনক। নিরপেক্ষ জলবায়ু গবেষক, আন্দোলনকর্মীদের ওপর তো দমনপীড়ন চলছেই। নবি জেরেমিয়ার ভবিষ্যদ্বাণীকে যেমন শাসকরা সহ্য করতে পারেনি, ঠিক তেমনি। কিন্তু অন্ধ হলে তো আর প্রলয় বন্ধ হয় না। যেভাবে জেরুজালেমের উপাসনালয় ধ্বংস হয়েছে সেভাবে হয়তো সকল মানমন্দির ধ্বংস হবে। ভারতচন্দ্র বলেছেন, “নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়?” 

কুরআনে নবিদের সতর্ককারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। “আর অবশ্যই আমরা নূহকে তাঁর সম্প্রদায়ের কাছে পাঠিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য প্রকাশ্য সতর্ককারী’” (সূরা হূদ: ২৫)। কিন্তু নূহ নবির সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া ছিল এরকম, “বরং আমরা তোমাদেরকে মিথ্যাবাদী মনে করি” (সূরা হূদ: ২৭)। নূহ নবি সতর্কতার বিনিময় প্রসঙ্গে বলেন, “এর পরিবর্তে আমি তোমাদের কাছে কোনো ধন-সম্পদ চাই না” (সূরা হূদ: ২৯)। এভাবে আমাদের জলবায়ু বিশারদরা বিনা স্বার্থে আমাদের করণীয় উপস্থাপন করলেও কি আমরা সতর্ক হবো? যখন নূহ নবি তাদের ব্যাপারে হতাশ হয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেন, তখনও তারা তাঁকে উপহাস করেছে। “আর তিনি নৌকা নির্মাণ করতে লাগলেন এবং যখনই তার সম্প্রদায়ের নেতারা তার পাশ দিয়ে যেত, তাকে নিয়ে উপহাস করত” (সূরা হূদ:৩৮)। সৃষ্টিকর্তা নূহকে নির্দেশ দিলেন, “এতে উঠিয়ে নিন প্রত্যেক শ্রেণির যুগলের দুটি” (সূরা হূদ: ৪০)। মহাপ্রলয়ের মুহূর্তেও বাস্তুসংস্থান নিয়ে সৃষ্টিকর্তা তার বার্তাবাহককে অবগত করলেন। নবিগণের ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে বর্তমান যুগের সংস্থাসমূহের পার্থক্য স্বার্থবাদীতায় ও সত্যবাদীতায়। অপচয় পাপ। পরিবেশ দূষণ কি পাপ নয়? আপাতদৃষ্টিতে এ পাপের শাস্তি মহাদুর্যোগ। 

বাংলাদেশের জন্য জলবায়ু সতর্কতার ক্ষেত্রগুলো লক্ষ করলে দেখা যায়-বৃষ্টিপাত হ্রাস, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, অস্বাভাবিক তাপমাত্রা, মরুকরণ, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস, সুপেয় পানির অভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড় বা টর্নেডো, জলোচ্ছ্বাস, স্থায়ী জলাবদ্ধতা, শিলাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি ও তীব্র বন্যা, নদীভাঙন, ভূমিধ্বস, ভূমিকম্প বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক সম্পদ হ্রাস, খাদ্য সংকট, স্বাস্থ্যঝুকি, জলবায়ু উদ্বাস্তু বৃদ্ধি ও মানবাধিকার লঙ্ঘন ইত্যাদি যা দিনদিন প্রকট হয়ে উঠছে। বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্র, শক্তিহীন রাষ্ট্র, শক্তিমান নাগরিক, শক্তিহীন নাগরিক সবাই জলবায়ু সতর্কতাকে উপহাস করছে। কিন্তু এসব থেকে বের হয়ে আসা জরুরি। 

মনে পড়ছে, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরের কথা। ক্রমাগত বৃষ্টি পড়ছে। বিকেল বেলা বিদ্যুৎ চলে গেল। ভারত-পাকিস্তান একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা দেখছিলাম বাংলাদেশ টেলিভিশনে। তখন ৯/১০ বছর বয়স। পাশের বাড়ি চলে গেলাম বড় ভাইয়ের সাথে। বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন ভিন্ন হওয়ায় সেখানে বিদ্যুৎ ছিল তখনও। খেলা দেখছি। খুব সম্ভবত পাকিস্তানের ইউনিস খান ও মোহম্মদ ইউসুফ ব্যাট করছিলেন। একটু পরপর বিশেষ বুলেটিন দেখাচ্ছিল বিটিভিতে। এক ওভার বিরতিও হবে না হয়তো। ঘূর্ণিঝড় সিডর আসছে। মহাপ্রলয়ঙ্করি। বিপদসংকেত বাড়তে বাড়তে ১১ নম্বর মহাবিপদসংকেত চলে আসলো। কিছুক্ষণ পর সেখানেও বিদ্যুৎ চলে গেল। আমরা ঘরে ফিরলাম। সেদিন আর খেলার ফল জানা হয়নি। কারণ পরবর্তী প্রায় তিন মাস বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন ছিলাম। রাতে শুরু হয় তাণ্ডব। অথচ বিকেলে খেলা দেখছিলাম কত আনন্দে! বিশেষ বুলেটিন কৌতূহল নিয়ে শুনছিলাম। এরকম শুনিনি আর। উপকূলে সিডরের তাণ্ডব সবারই জানা। আমাদের এলাকাও পরিণত হয় ধ্বংসস্তুপে। গাছ ভাঙা, ঘর ভাঙা...তছনছ সবকিছু। সমুদ্রোপকূলে বাঁধ ভেঙেছে। বিভিন্ন হিসেবে প্রায় সাড়ে তিন হাজার থেকে পনেরো হাজার নিহতের খবর পাওয়া যায়। প্রায় আড়াইশো কোটি ডলারের ক্ষয়ক্ষতি হয় তখনকার হিসেবে। সেই বিভীষিকা আজও জ্বলজ্বল করে স্মৃতির পাতায়। মানুষ ইদানিং জলবায়ু সতর্কতাকে হাসিঠাট্টার বিষয়ে পরিণত করেছে। অথচ এর পরিণাম কতই না ভয়ংকর! হোমারের মতো ধ্বংসগাথা গাইতে কেউ কি থাকবে পৃথিবীতে? 

*জলবায়ু সংক্রান্ত তথ্যের উৎস: “স্টকহোম থেকে কিয়োটো: জলবায়ু পরিবর্তনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।” (পিটার জ্যাকসন, ২০০৭)


***লেখাটি ৩০ মার্চ ২০২৫ খ্রি. তারিখে সাপ্তাহিক অজানা খবর পত্রিকার পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। (প্রথম পাতায় প্রথম কলামে (নিচে) ছাপা হয়।)

*লেখক-মোঃ ফেরদৌস আলম, 
সাবেক শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


মন্তব্যসমূহ

  1. তথ্যবহুল ও ভিন্না ধারার চিন্তাসমৃদ্ধ। শুভকামনা।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. অনুগ্রহপূর্বক পড়ার জন্য ধন্যবাদ। আপনার সুচিন্তিত মতামত পরবর্তী লেখার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা যোগাবে।

      মুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শকুন ও সংস্কৃতির দ্বন্দ্ববিচার

একটি জাতীয়তাবাদী নাটিকা : বাংলা ও বালআমের গাধা