একটি জাতীয়তাবাদী নাটিকা : বাংলা ও বালআমের গাধা
[একজন কথক সংলাপ বহির্ভূত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বর্ণনা বয়ান করবেন।]
সুপ্রিয় জাতীয়তাবাদী মানুষজন! আজ আমরা জাতীয়তাবাদের বিচার করবো। জাতীয়তাবাদ যুগ যুগ ধরে বিকশিত হয়েছে। জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে আমরা কী পেলাম, কী হারালাম! সমস্যা হলো-কী দিয়ে বিচার করবো! বিবেক? মানুষের বিবেক কি চূড়ান্ত বিচারে সক্ষম? বিবেক দিয়ে বিবেকের বিচার বড়োই কঠিন! আসুন, আমরা পক্ষে-বিপক্ষে আলাপ করি। পৌরাণিক কাহিনী ও ইতিহাসকে টেনে আনি বিচারের সূত্র হিসেবে। চলুন, জাগিয়ে তুলি সময়কে।
প্রথম অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
[বালাকের রাজদরবারে উৎকণ্ঠিত সবাই। যার অবস্থান যতো উপরে, তার চিন্তার পারদও ততো উপরে। পয়গম্বর ইউশার বাহিনী অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে আসছে। সেনাবাহিনী যুদ্ধের ব্যাপারে হতাশ হয়ে পড়েছে।]
রাজা: (সকাল সকাল সভায় উত্তেজিত কণ্ঠে) আপনারা এভাবে বসে থাকবেন না। দ্রুত কোনো উপায় খুঁজে বের করুন। ইউশার বাহিনীকে যুদ্ধ করে কেউই থামাতে পারছে না। আমাদের বুদ্ধি দিয়ে জিততে হবে।
সেনাপতি: মাননীয়, শোনা যাচ্ছে ইউশার বাহিনীর পথে সকল প্রতিরোধ ধূলির মতো উড়ে যাচ্ছে। এমনও শোনা যাচ্ছে যে, ইউশার শক্তির উৎস তার গড়পড়তা সেনাদল হতে পারে না। সে মুসার খোদার সাহায্যে এগিয়ে যাচ্ছে।
রাজা: আমাদের খোদাকে ডাকো। বাল মন্দিরের যাজকদের ডেকে আনো!
মন্ত্রী: জো হুকুম, মাননীয়।
দ্বিতীয় দৃশ্য
[বেলা দ্বিপ্রহর]
যাজক: মহারাজ, আপনার জাঁকজমকের এ শহরকে বাঁচান। বালের মন্দিরকে বাঁচান। ইউশা এলে ক্ষ্যাপা লোকজন তার দলে ভিড়তে শুরু করবে।
রাজা: আপনি আমাকে আশাহত করছেন। শুনলাম, ইউশার খোদা ওদের সহায়। আপনি বালের মন্দিরে প্রার্থনা করুন। ইউশা ও তার খোদাকে আমরা হারাবো।
যাজক: মহারাজ, অপরাধ ক্ষমা করবেন। আমরা চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখছি না। কিন্তু সৈন্যদের মনোবল ভেঙ্গে পড়েছে।
জনৈক সভাসদ: মহারাজ, ক্ষমা করবেন। আমরা বালআম বাউরকে অনুরোধ করতে পারি।
রাজা: বালআম! ওই নিভৃতচারী লোকটা? ও তো শুনেছি বাল-এর উপাসনা করে না।
সভাসদ: কিন্ত মহারাজ, তার প্রার্থনা বিফল হয় না। সে যদি আমাদের জন্য প্রার্থনা করে তবে আমরা ইউশার বাহিনীকে পরাজিত করতে পারবো।
রাজা: কিন্ত, সে কি তা করবে? কিন্তু....না, কোনো কিন্তু না! বালআমের কাছে যাও!
সভাসদ: জো হুকুম, মহারাজ।
তৃতীয় দৃশ্য
[অপরাহ্ণ-রাজার বিশ্রাম নেই। রাজার খাস কামরায় উক্ত সভাসদ]
সভাসদ: মহারাজ, বালআম রাজি হচ্ছে না।
রাজা: কিন্ত কেন?
সভাসদ: সে খোদার পয়গম্বরের বিরুদ্ধে প্রার্থনা করতে রাজি নয়।
রাজা: যেকোনো ভাবে হোক তাকে রাজি করাও। কী চাই তার! স্থাবর-অস্থাবর কোন সম্পত্তি সে চায়? কোন সুন্দরীর সেবা চায়?
সভাসদ: মহারাজ, বালআম দুনিয়াবিমুখ দরবেশ। অর্থ-সম্পত্তি দিয়ে তাকে রাজি করানো যাবে না। আর সে তার স্ত্রীকে নিয়ে সন্তুষ্ট।
রাজা: তার স্ত্রীকে তলব করো।
সভাসদ: জো হুকুম, মহারাজ।
চতুর্থ দৃশ্য
বালআমের স্ত্রী: মহারাজ, আমায় ক্ষমা করুন।
রাজা: না, না। তোমার কাছ থেকে না শুনতে চাই না। বালাকের এ দুর্দিনে তুমি আমাদের ফিরিয়ে দিতে পারো না। তুমি কী চাও বলো। তোমাকে অঢেল সম্পত্তির মালিক করে দেওয়া হবে।
বালআমের স্ত্রী: মহারাজের অনুগ্রহ।
রাজা: তুমি শুধু বালআমকে রাজি করাও।
বালআমের স্ত্রী: মহারাজ, আমিও বালাকের ভালো চাই। কিন্তু বালআম! সে কিছুই চায় না।
রাজা: তুমি তো চাও। তাহলে আর কোনো কথা শুনতে চাই না। যেকোনো মূল্যে বালআমকে রাজি করাও। ইউশার বাহিনী এসে পড়ল বলে। তখন কেউই রেহাই পাবে না।
বালআমের স্ত্রী: মহারাজ, আমাকে আজ রাতটুকু সময় দিন।
রাজা: তবে তাই হোক।
পঞ্চম দৃশ্য
জাতীয়তাবাদী বন্ধুগণ! বালাকে সুশাসন কতটা ছিলো-তা আমরা বিচার করবো না। ইউশার আগমনকে জনগণ ভয় নিয়ে স্বাগত জানাতে চায় কিনা তাও স্পষ্ট করছি না। তবে ভিন্ জাতির শাসন জাতীয়তাবাদ মেনে নেবে না। জাতীয়তাবাদের রক্ষক রাজাও মেনে নিতে প্রস্তুত নয়।
সে রাতে বালআমের স্ত্রী কী প্রকারে বালআমকে রাজি করিয়েছে তাও আমরা খোলাসা করবো না। সবাই আশা নিয়ে বালআমের প্রার্থনার পথে দাঁড়িয়ে গেল। বালআম তার গাধার পিঠে চড়ে এগিয়ে যাচ্ছেন নির্জন পাহাড়ে। তাকে আজ তার উপাস্যের প্রেরিত পয়গম্বরের বিরুদ্ধে তারই কাছে প্রার্থনা করতে হবে। অনেক সাধনায় প্রার্থনার যে অব্যর্থ মন্ত্র সে শিখেছে তাই আওড়াতে চেষ্টা করলো।
এ কী! সবাই উৎকণ্ঠার সাথে শোরগোল শুরু করলো। বালআমের গাধা সামনে আগাতে চাচ্ছে না কেন? বালআম গাধাকে প্রহার করলো। গাধা দুয়েক পা হেঁটে এবার মুখ ঘুরিয়ে নিল। গাধার মুখের দিকে তাকিয়ে বালআম ভীত হয়ে পড়লো। কোনো খোদায়ী শক্তি কি গাধার পথে প্রতিবন্ধক হয়েছে?
শেষবারের মতো বালআম গাধাকে তাড়া দিলো। আবার গাধা দুয়েক পা এগুলো। কিন্তু না। এর বেশি না। বালআমের দিকে মুখ ঘুরিয়ে থেমে দাঁড়ালো গাধা। বালআমের মনে হলো গাধা বিবেকপ্রাপ্ত হয়েছে। তার স্ত্রীর মধ্যে, তার মধ্যে যে বিবেক ঘুমিয়ে গেছে সেই বিবেক গাধার মধ্যে জেগেছে। করুণ কান্নাভরা গাধার দৃষ্টি।
সকলে দেখলো গাধা বালামকে কিছু বলছে। কিন্তু কেউ শুনতে পেলো না। অগত্যা বালআম হেঁটে চললো পাহাড়ের চূড়ায়। আর কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে না। হায় হায়! সেই অব্যর্থ মন্ত্র তো বালআম বলতে পারছে না। সেই সাধনার ফল তো সে আস্বাদন করতে পারছে না আর! বালআম স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছে।
সব প্রার্থনা ভুলে বালআম বললো-হে খোদা! আমাকে বাঁচাও!
ষষ্ঠ দৃশ্য
বন্ধুরা! কী হয়েছিল সেদিন বালাক ও ইউশার বাহিনীর মধ্যে? জনগণ কী জেগে উঠেছিল তাদের দেশকে বাঁচাতে? না, জনগণ বরং ছিল উৎকণ্ঠিত দর্শক। সেটাই হয়। দেশের প্রত্যেক নাগরিক দেশের জন্য যুদ্ধ করে না। উদ্দীপ্ত হয়ে যারা সেনাবাহিনীর বিপদকালীন অংশ হয় তারা ব্যতীত জনগণ কিছুই করতে পারে না। কিংবদন্তি মতে, ইউশার বাহিনীর নৈতিক শক্তি ও শৌর্য-বীর্য নষ্ট করতে বালাকের নারীদের উলঙ্গ করে তাদের কাছে পাঠানো হয়। হায় রে জাতীয়তাবাদ!
দোদুল্যমান জনতা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে। রাজা তাদের লাঞ্চনার হাত থেকে বাঁচাবেন-এই আশায় তারা একটা সময় পর্যন্ত রাজার জয় কামনা করে। কিন্তু পরাজিত রাজার জন্য তাদের কিছুই করার নেই। জাতীয়তাবাদ একটি চুইয়ে পড়া চেতনা! জাতীয়তাবাদ টিকিয়ে রাখার গুরুভার রাজার কাঁধে এবং তা রাজার স্বার্থেই বেশি।
দ্বিতীয় অঙ্ক
বন্ধুরা! আসুন, আমরা বাংলায় ফিরে আসি। বাংলাদেশে ফিরে আসি। বাংলাদেশ নামের অস্তিত্ব তখন ছিলো না। এই ভূখন্ডের এক খন্ডের নাম ছিলো বঙ্গ। ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল ভিন্ন ভিন্ন সময়ে পরিচিত ছিলো ভিন্ন ভিন্ন নামে। নেগ্রিটো, অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, আর্য ইত্যাদি জাতিগোষ্ঠির আগমন-নির্গমনে এ ভূমি আলোড়িত হয়েছে প্রাচীন কাল থেকে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে ঘটে আরও একটি এমন ঘটনা। অভিষেক-বহিষ্কারের ঘটনা। সেন রাজার প্রজাদের উল্লেখযোগ্য অংশ ছিলো বৌদ্ধ। বৌদ্ধ বিহারের ঐতিহ্য ম্লান হয়েছে পালদের পতনে।
প্রথম দৃশ্য
নতুন বিজেতা ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজি আসছেন। সেন রাজমহলে উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। বেশ কিছুদিন যাবৎ প্রাকৃতজনের মধ্যে আলোড়ন বয়ে যাচ্ছে। কীসের আলোড়ন! নতুন কিছুর জন্য তারা কী প্রস্তুত? কিন্তু কেন? কারণ তাদের কিছুই করার নেই। রাজার আসন্ন পতন সম্পর্কে তারা প্রায় নিশ্চিত। তাদের দোদুল্যমান মন দুলে যাচ্ছে কালের দোলায়। তবু তারা জন্মভূমি ত্যাগ করতে পারে না। মালিকানা থাক বা না থাক-এ মাটি তাদের শেষ আশ্রয়।
অভিজাত ধনিক শ্রেণি, যাজক শ্রেণি ও শাসক শ্রেণি পালানোর রাস্তা খুঁজে ফেরে। তাদের প্রাণের অনেক দাম। জানমাল অথবা মালজানের মায়ায় তারা কাতর! পারলে তারা মালিকানায় থাকা, দখল করা মাটিটুকুও নিয়ে যায়! কারণ এ মাটি তাদের কাছে স্থূল সম্পদ বৈ তো নয়! এ মাটি কভু তাদের আশ্রয় নয়।
হলায়ুধ মিশ্র খিলজিকে স্বাগত জানিয়ে লিখলেন,
“সাধু ম্লেচ্ছ নরেন্দ্র সাধু ভবতৌ মাতৈন বীরপ্রসুর
নীচেনাপি ভবদ্বিধেন বসুধা সুক্ষত্রিয়া বর্ততে।” (সেখ শুভোদয়া)
(স্বাগত ম্লেচ্ছরাজ, তোমার মা-ই প্রকৃত বীরপ্রসবিনী।
নীচ হলেও তোমার জন্যই বীরপ্রসু পৃথিবী।)
দ্বিতীয় দৃশ্য
[বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মৃণালিনী’ উপন্যাস থেকে বখতিয়ার খিলজির দূতকে লক্ষ্মণ সেনের সেনাপতি পশুপতির পরিমার্জিত সম্ভাষণ]
পশুপতি: আমি খিলজিকে এ রাজ্য দিতে অনিচ্ছুক নই, অক্ষমও নই। আমিই আসল রাজা। লক্ষ্মণ সেন তো আলঙ্কারিক রাজা। কিন্তু যথেষ্ট মূল্য তো চাই। আমার অনুমতি ছাড়া একটি পদাতিকও যুদ্ধ করবে না। রাজকোষও আমার বিশ্বস্ত লোকের অধিকারে আছে। যুদ্ধের আয়োজনে একটি পয়সাও খরচ হবে না। পাঁচজন সৈন্য নিয়ে খিলজিকে রাজধানীতে আসতে বলো, কেউ বাধা দিবে না।
বন্ধুরা! যবনদূতকে বঙ্কিমচন্দ্র যমদূত বলেছেন। লক্ষ্মণ সেনকে বলেছেন রাজকুলকলঙ্ক। ঐতিহাসিক মিনহাজ উদ্দীন-এর বর্ণনা আফসোসের সাথে উদ্ধৃত করেছেন বঙ্কিম।
“বখতিয়ারের ঘোড়ার পদশব্দ লক্ষ্মণ সেনের অন্দরমহলে যখন পৌঁছেছিল তখন তিনি খাচ্ছিলেন। ভয়ে থরথর রাজার মুখ হতে খাবার পড়িয়া যায়। তিনি পিছনের দরজা দিয়ে সোনারগাঁ পালিয়ে যান।”
তৃতীয় দৃশ্য
প্রদোষে প্রাকৃতজনদের অবস্থা জানতে ইতিহাস আমাদের খুব কমই সাহায্য করে। রাজবংশের গৌরবে প্রদোষে তারা কতটা গর্বিত তা কল্পনার বিষয় হয়ে উঠেছে। মনের মাধুরি মিশানো উপখ্যান আমরা পড়ি। শুধু রাষ্ট্র শাসনেই নয়, ধর্ম-কর্মেও প্রভাব পড়ে নতুন জাতির। তার বঞ্চনা তখন বড়ো হয়ে দেখা দেয়। অরক্ষিত জনতা প্রলুব্ধ হয় নতুনের আশ্রয় লাভে।
বন্ধুরা! শওকত আলী’র উপন্যাস ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ এ ব্যাপারে সরব।
লীলাবতী: আমার ধর্ম কি আদৌ ছিলো কিছু? যা ছিলো তা আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। এমন বিয়ে দিয়েছে যা আমি চাইনি। আমার জীবনকে বিপর্যস্ত করেছে। আমার পিতাকে কেড়ে নিয়েছে। (পরিমার্জিত সংলাপ)
চতুর্থ দৃশ্য
বন্ধুরা! জাতীয়তাবাদ কি প্রাকৃতজনকে আন্দোলিত করতে পেরেছে? বৃদ্ধরাজা লক্ষ্মণ সেনের সিংহাসন রক্ষা করতে পেরেছে? ওহ, দুঃখিত! রাজাই তো জাতীয়তাবাদী সিংহাসনের রক্ষক। জাতীয়তাবাদ তখনও মনে হয় শিশু। সেন রাজারাও তো সেই দক্ষিণ ভারত থেকে এসেছেন। তারা হয়তো প্রাকৃতজনের আপন না! আপন না হলেও তাদের কাছে তাদের আপন রাজারা বিজিত হয়েছে। আর খিলজি বাহিনীই কি তাদের আপন? সে জবাব প্রাকৃতজন জানে না। কালের স্রোতে তারা ভেসে চলেছে।
তৃতীয় অঙ্ক
জাতীয়তাবাদী সুধী! চলুন, আমরা এক পলকে ছয়শো বছর পেরিয়ে যাই। পশুপতির মতো মীর জাফর স্বরাজকে অর্পণ করলেন ব্রিটিশদের হাতে। এবার মুসলমানদের অপদস্থ হওয়ার পালা। বাস্তবে যতটা না, তার চেয়ে বেশি ছয়শো বছর অপেক্ষারত উপখ্যানলেখকদের কলমে, আকাশকুসুম আনন্দমঠে। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের জন্য ব্রিটিশদের দায়মুক্তি দিয়েছেন বঙ্কিম। মুসলিম শাসনের অবসান করায় ব্রিটিশদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করলেও মীরজাফরের নিন্দা করতে ছাড়েননি তিনি। বলেছেন, মীরজাফর “পাপিষ্ঠ নরাধম বিশ্বহন্তা মনুষ্যকুলকলঙ্ক”। মীরজাফর আত্মরক্ষায় অক্ষম, বাংলা রক্ষা করবে কীভাবে? তাও ভালো।
তবে বঙ্কিমের জাতীয়তাবাদ বিপথে গেল। তার জাতীয়তাবাদীরা মীরজাফরের চেয়েও বেশি ঘৃণা করতে শুরু করলো সাধারণ মুসলমানদের যাদের অধিকাংশই এ মাটির সন্তান।
প্রথম দৃশ্য
(বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘আনন্দমঠ’ থেকে পরিমার্জিত উদ্ধৃতি)
বঙ্কিমের সন্ন্যাসী ১: চলো, আমরা মুসলমান বসতি ভাঙিয়া ধূলিগুঁড়ি করি। সেই শুয়োরদের অগ্নিসংস্কার করে নদীর জলে ফেলে দিই। সেসব বাবুইয়ের বাসা ভেঙে বাতাসে উড়িয়ে দিই!
বঙ্কিম সন্ন্যাসী ২: আমরা রাজ্য চাই না। যবনেরা ভগবানবিদ্বেষী বলে তাদের নির্মূল করতে চাই।
স্ত্রী সন্ন্যাসী: ইংরেজ! হিন্দু-মোছলমানে মারামারি হচ্ছে, তোমরা মাঝখানে কেন?
বঙ্কিম সন্ন্যাসীগণ: ভাই, এমন দিন কি হবে, মসজিদ ভেঙে রাধামাধবের মন্দির গড়ব?
বঙ্কিম সন্ন্যাসী ৩: ইংরেজ! তোমরা আমাদের শত্রু নও। কেন তোমরা মুসলমানদের সাহায্যে এসেছো? ইংরেজের জয় হোক, আমরা তোমাদের সুহৃদ।
দ্বিতীয় দৃশ্য
বন্ধুরা! বঙ্কিমের সন্ন্যাসীরা যেভাবে ইংরেজকে গ্রহণ করেছে, তেমনি নির্যাতিত বৌদ্ধভিক্ষুরাও কি মুসলমানদের গ্রহণ করেনি? তবে বৌদ্ধরা লক্ষ্মণ সেনের স্বজাতিকে এরকম উৎপীড়ন করেছে কিনা তার উল্লেখ বঙ্কিম করেননি।
বঙ্কিম আমাদের আরও বলেছেন যে, সন্ন্যাসী বিদ্রোহ আদৌ ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহ ছিল না। সে হিসেবে ফকিররাই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন-সেটা গোত্র স্বার্থে হলেও।
শেষ অঙ্ক
বন্ধুরা! আপনারা বিচার করুন কোন অঙ্কে জাতীয়তাবাদ বিজয়ী হয়েছে? কে শ্রেষ্ঠ জাতীয়তাবাদী? জাতীয়তাবাদ কি মানবতাবাদী? আমি এই বিচারের উপযুক্ত নই। আমার রায়ও আপনারা বিচার করুন।
অন্যায়কাজে নিজ পরিবার, গোত্র, সমাজ ও রাষ্ট্রকে সমর্থণ ও সহযোগিতা করা অন্যায়েরই নামান্তর। জাতিকে সাহায্য করতে চাইলে তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করুন। তাদের মনের অন্ধকার দূর করুন। তাদের চলার পথকে আলোকিত করুন। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মানুষকে ভালোবাসুন। মানুষকে বাদ দিয়ে জন্মভূমির মাটি জন্মভূমি নয়। কোন জাতি চিরকাল তার জন্মভূমিতে টিকতে পেরেছে? নিজে নির্মূল হওয়ার ভয়ে অন্যকে নির্মূল করতে গেলে সবাই নির্মূল হবে।
বালআমের সে প্রাচীন নগরী থেকে আবহমানকালের বাংলা; জাতীয়তাবাদ কোথাও স্থিতি লাভ করেনি। বালআমের নিরীহ গাধা থেকে বর্তমান বিশ্বের নিপীড়িত জনতা; জাতীয়তাবাদ কাউকে নিশ্চয়তা দিতে পারেনি।
![]() |
*লেখক-মোঃ ফেরদৌস আলম, সাবেক শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। |
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন