ভক্তির ভাষা

রোজার মাস। অন্য সময় যারা মসজিদের ধারে কাছে যায় না তারাও এখন নিয়মিত নমাজ-কালাম পড়ছে। মন দিয়েই পড়ছে। নমাজের সময়ের আগেই গ্রামের তরুণরা মসজিদে আসতে শুরু করছে। সুমনের সঙ্গে আরো কয়েকটা ছেলে মসজিদের কাছে এলো। নমাজের এখনো অনেক দেরি। হয়তো মসজিদের বারান্দায় বসে গল্প করবে ওরা। আজান হলে নমাজ পড়বে। গ্রামের আধাপাকা মসজিদ। সামনে পুকুর। পুকুরে অজু করছিল সুমন। সঙ্গী জহির, তাহের, তারেক ও হাফিজ আগে অজু করে মসজিদের দিকে গেল। তাহের ডাক দিলো : সুমন ভাই, দেখে যাও অবস্থা! 

Photo Credit: https://cdn.dhakapost.com/media/imgAll/BG/2023February/untitled-1-20230218025655.jpg
গল্পটি অন্বেষা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাহিত্য সংসদের গল্প সংকলন কিচ্ছা’য় প্রকাশিত হয়।

সুমন অজু শেষ করে দরজার সামনে আসতেই তারেক দেখিয়ে দিলো--খালি পা দুটো চৌকাঠের বাইরে রেখে কেউ একজন শুয়ে আছে। বয়স্ক লোক। ভালো করে দেখতেই দেখা গেলÑবৃদ্ধ বারুই, এই এলাকায় পান-সুপারি ফেরি করেন। নজরে এলো--দেয়াল ঘেঁষে রাখা পান ফেরি করার থালা। 

হাফিজ অবাক হয়ে বললো : সে কি! হিন্দু মানুষ মসজিদে কেন?

সুমন ওদের থামিয়ে দিয়ে বললো : এদিকে এসো। ওরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও মসজিদের একটু দূরে পতিত গাছের গুঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।

যেতে যেতে হাফিজ বললো : কী সাহস! হিন্দু হয়ে মসজিদে উঠেছে! শিগগির একটা ব্যবস্থা নাও। 

তারেক বললো : এখনই ডেকে বের করে দাও।

জহির রাগে ফুসছিলো। কিছু বললো না। 

সবাইকে অবাক করে দিয়ে সুমন বললো : আরেকটু ঘুমাতে দাও। আজানের সময় হলে দেখো। 

সুমনের কথা কেড়ে নিয়ে হাফিজ বললো : সে কেমন কথা! একটা হিন্দু কেন মসজিদে ঢুকবে?

সুমন বললো : আস্তে বলো, জেগে উঠবেন লোকটা। একটু চিন্তা করো। তিনি তো আমাদেরই গ্রামে পান-সুপারি ফেরি করেন। বুড়ো মানুষ। দুপুরে হয়তো কিছু খেতেও পারেননি। রোজার দিন বলে মুসলমান ঘরে পানি চাইতেও হয়তো ইতস্তত বোধ করেছেন। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। কোথাও একটু বসার জায়গা না পেয়ে মসজিদের চৌকাঠে বসেছে। পান-সুপারির থালাটা দেখো--দেয়াল ঘেঁষে রেখেছেন। ক্লান্ত হয়ে নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। দেখো, পা দু’টি চৌকাঠের বাইরে। রোজার মাসে সংযত হতে শেখো। নবীজী কাউকে কষ্ট দিতে শেখাননি। মনে নেই সেই ঘটনা? নবীজীর মসজিদে এক বেদুইন প্রস্রাব করছিলো। সাহাবাগণ রেগে গেলে নবীজী বললেন--বাধা দিও না। তার প্রস্রাব করা শেষ হলে জায়গাটা ধুয়ে পরিষ্কার করলেই হবে।

জহির বলে উঠলো : কিন্তু...সবাই এসে পড়লে তো ঝামেলা বেঁধে যেতে পারে। তার থেকে আগেই ওনাকে ডেকে দেই, কী বলো?

সুমন বললো : ওই শোনো, আজান শুরু হলো। দূরের মসজিদের মাইকের আওয়াজ শোনা যায়। সবাই মসজিদের বারান্দার দিকে এগিয়ে যেতেই দেখলো, বারুই লোকটি হুড়মুড় করে উঠে পড়লেন। আজান শুনে তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইলেন মুহূর্তকাল।

সুমনদের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ বারুই লজ্জিত হয়ে বললেন : একটু বসেছিলাম ক্লান্ত হয়ে। বুড়ো শরীর--কখন ঘুমিয়ে গেছি! মাফ করে দাও দাদুরা। বাইরেই বসতাম, কিন্তু পান-সুপারির থালাটা নিরাপদে রাখতেই এখানে বসেছি। বসা মাত্রই নিবিড় ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম!

সুমন বললো : শান্ত হোন, দাদু। আপনার কোনো অপরাধ নেই। 

পানের থালাটা এগিয়ে দিয়ে জহির বললো : আপনার বাড়ি তো সেই দূর গ্রামে। আমাদের সঙ্গে না হয় ইফতার করে যান। 

লোক সমাগম দেখে বারুই লোকটি আর কথা না বাড়িয়ে বাড়ির পথ ধরলেন। সন্ধ্যার আগে বাড়ি যেতে হবে যে! যেতে যেতে আসরের আজান শোনা যায়। বাড়ির আঙিনায় যেতেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। দূর গ্রামের মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি স্পষ্ট শোন যায় না। এখন সেখানে ইফতারের সময়। কাছের মন্দির থেকে সন্ধ্যার বেদবাণী শোনা যায়। কিন্তু বৃদ্ধ বারুই দুপুরের খাবার খেতে পারেননি এখনো। তিনি দাওয়ায় বসে দুপুরে রেখে দেয়া খাবার খাচ্ছেন কর্মব্যস্ত দিনের শেষে। বৃদ্ধ বারুই বেদবাণীর ভাষা জানেন না। জানেন না আজনের ভাষাও। তবে ভক্তির ভাষা তার জানা আছে। এই তার সম্বল। 

*লেখক-মোঃ ফেরদৌস আলম, 
সাবেক শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

জেরুজালেমের নবি যেরেমিয়া ও জলবায়ু সতর্কতা

শকুন ও সংস্কৃতির দ্বন্দ্ববিচার

একটি জাতীয়তাবাদী নাটিকা : বাংলা ও বালআমের গাধা