শকুন ও সংস্কৃতির দ্বন্দ্ববিচার
![]() |
Photo Credit: https://www.clipartmax.com/middle/m2i8b1b1Z5m2i8i8_uzbekistans-emblem-uzbekistan-gerb-png/ পতাকা খামচে নয়, বরং উজবেকিস্তানে জাতীয় প্রতীকের আভিজাত্যে রয়েছে শকুন। |
সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণায় Dialectics অন্যতম আলোচিত একটি পদ্ধতি। বাংলায় বলা যায় দ্বন্দ্ববিচার। কোনো বিষয়ে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির মতামত থেকে সঠিক মত বের করার প্রক্রিয়া হিসেবে একে সংজ্ঞায়িত করা যায়। যাহোক, এখানে শকুন নিয়ে বিভিন্ন সংস্কৃতির অবস্থান বিচার করার চেষ্টা করছি।
প্রথমে শকুন সংক্রান্ত আমার অভিজ্ঞতা বলা দরকার। শেষবার সরাসরি শকুন দেখেছি অনেক বছর আগে। এক যুগ তো হবেই। স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে তাহলে এরকম...সুগন্ধা নদীর শাখা খালের মোহনায় আটকে আছে মৃত গরু বা কিছু একটা। কয়েকটি শকুন এসে পড়েছে তার ওপর। নানাবাড়ি বেড়াতে গিয়ে এক রৌদ্রোজ্জ্বল বিকেলে দেখেছিলাম। আর দেখেছি বলে মনে পড়ে না। এরপর অনেক প্রতিবেদন দেখেছি এবং ফিচার পড়েছি শকুন বিলুপ্তি সংক্রান্ত। যায় যায় প্রাণ আমাদের সমাজে শকুন অশনি সংকেতই বহন করে। শকুন বলে গালি দিতেও শোনা যায় এখানে। নিয়মিত বিরতিতে দুর্ভিক্ষপীড়িত এ দেশের মাটিতে দস্যু-লুটেরাদের কল্যাণে শকুন সর্বদাই পেয়েছে জীবনের গন্ধ। আজরাইলের আগমনী বার্তা পাওয়া যেত শকুনের আনাগোনায়। আবার, শকুন হয়েছে শোষণের প্রতীক। নরপশুদের থাবার উপমা হয়েছে শকুনের খামচে ধরা। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ কবিতায় বলেছেন,
“জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ পুরোনো শকুন।”
বর্তমানে শকুন এ দেশে একটি বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী। এর অর্থ এ নয় যে, বাংলায় আজ কোনো অশনী সংকেত নেই। এও নয় যে, বাংলা আজ বিপদমুক্ত। মৃত মানুষ কিংবা অন্য প্রাণী আজও খালে-বিলে ভাসে। দক্ষিণ বাংলার অধিকাংশ রাস্তা-ই খালের পাশে। কারণ খালের মাটি দিয়ে রাস্তা তৈরী। কচুরিপানা ভেসে যায় খালে। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আসা এ জলজ উদ্ভিদের সাথে ভাসতে দেখা যায় মৃত গবাদি পশু, কুকুর-বিড়াল ইত্যাদির মৃতদেহ। দুর্গন্ধে দৌড়ে পালায় জীবিত মানুষ। কোনো শকুন নেই। কিংবা নদীতে ভাসতে দেখা যায় কোনো নিহত মানুষের নিথর দেহ। সেখানেও শকুন নেই। অবশ্য মৃত মনুষ্য দেহ সৎকারের দাবি রাখে!
শকুনের অনেক জাত আছে বিশ্বব্যাপী। বাংলা শকুন বিলুপ্তির অন্যতম কারণ এর বাসস্থান ধ্বংস। বন অধিদপ্তরের তথ্য মতে গবাদি পশুর চিকিৎসায় ব্যবহৃত ব্যথানাশক মরণঘাতী ঔষধ ডাইক্লোফেনাক ও কিটোপ্রোফেন শকুন বিলুপ্তির অন্যতম কারণ। মৃত প্রাণীদেহ থেকে শকুন আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। শকুনকে আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতিতে মোটেও সম্মানজনকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। আমাদের আশেপাশে এর আনাগোনাও খুব একটা সুখকর বলে বিবেচিত নয়। তাই হাজার হাজার শকুনের উধাও হয়ে যাওয়া আমাদের খুব একটা নজরে আসেনি। শকুনকে আমরা যেভাবে নৃশংস হিসেবে দেখি সেভাবে অন্যসব সমাজ-সংস্কৃতিতে দেখা হয় না। কোথাও কোথাও শকুন আভিজাত্যের প্রতীক। উজবেকিস্তানের জাতীয় প্রতীকে রয়েছে শকুন। রয়েছে ইরানের জাতীয় বিমান সংস্থার প্রতীকেও। যদিও এর প্রজাতি ভিন্ন, তবুও এরা শকুন। মিশরেও আছে শকুনের পৌরাণিক আভিজাত্য। মর্ত্যের শকুনের সাথে অনেকে পৌরাণিক শকুনকে মেলাতে চাইবেন না। পারস্য সাহিত্যে আমরা শকুনকেই ‘হোমা’ হিসেবে দেখতে পাই। এসব সংস্কৃতিতে শকুনের মূল্যায়নের দ্বন্দ্ববিচার করতেই এ আলোচনার অবতারণা।
![]() |
Photo Credit: https://www.pngegg.com/en/search?q=iran+Air ইরানের জাতীয় বিমান সংস্থার প্রতীকে হোমা বা শকুন। |
পারস্য সাহিত্যের প্রাণপুরুষ সূফি শেখ ফরিদ-উদ্-দ্বীন আত্তার তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘মানতিকুত তয়ির’ (পাখিদের পরামর্শ পরিষদ)-এ বিভিন্ন লৌকিক ও পৌরাণিক পাখির মধ্যে শকুনের পরিচয় দিয়েছেন এভাবে,
“এবার হোমা (শকুন) সভার সামনে দাঁড়ালো। ছায়াদানকারী হোমা যার ছায়া রাজাদের শোভা বাড়ায়। যার জন্য তার নাম ‘হুমায়ুন’। ভাগ্যবান--কেননা সব প্রাণীর মধ্যে সে-ই সবচেয়ে বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী।”
সম্রাট হুমায়ুনের নাম তো আমরা সবাই জানি। হুমায়ুন অর্থ ভাগ্যবান। কারও মাথায় হোমা বা শকুনের ছায়া পড়লে তাকে ভাগ্যবান মনে করা হয় পারসিক সংস্কৃতিতে! এখানে অবশ্য আরব্য কবিরা ভিন্ন কথা বলবেন। তাদের ভাষায়,
“শকুন যত উপরেই উঠুক, তার দৃষ্টি ঠিক ভাগাড়েই থাকে।”
বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম দিকপাল সূফি কবি শেখ সাদি তার গুলিস্তাঁয় বলেছেন,
“পেঁচার ছায়ায় কে যেতে চায়,
বিশ্ব থেকে হোমা যদিও বা হারায়।”
হিন্দু পুরাণে শনি দেবের বাহন হিসেবে শকুনের পরিচয় পাওয়া যায়। আবার, খোদাদ্রোহী নমরুদের আকাশে ওড়ার বাহন হিসেবে সেমেটিক পুরাণে শকুনের পরিচয় পাওয়া যায়। যাহোক, পৌরাণিক কাহিনী ছেড়ে বাস্তবে দেখতে হবে শকুনের এমন মর্যাদা কেন এসব সংস্কৃতিতে। অথবা, আকাশচুম্বি মর্যাদার হোমা-ই কি মৃতদেহ ভক্ষক শকুন? এর জবাব পাওয়া যায় শেখ সাদির গুলিস্তাঁতেই।
“হোমা মহত্ত্বে সব পাখিকেই ছাড়িয়ে যায়,
কারণ সে অসুস্থ ও মৃতের হাড়ে বাঁচে, জীবিত কারও নয়।”
এটাই আসল কথা। প্রাকৃতিক পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে শকুন মর্যাদার দাবিদার। শকুন কারও পতাকা খামচে ধরে না। বরং মানুষ যখন হিংস্র হয়ে শান্তির পতাকা খামচে ধরে, তখন শকুনের দায়িত্ব পড়ে মৃতদেহের জঞ্জাল সাফ করার। নরপশু যা খেতে পারে না, তা খেয়েই শকুন বাঁচে। সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব বিচারে মর্যাদা-অমর্যাদা যা-ই হোক না কেন, শকুনের বিলুপ্তি না হোক। বরং বিলুপ্তি হোক হিংস্র নরপিশাচদের। বাংলায় প্রবাদ আছে "শকুনের দোয়ায় গোরু মরে না"। তাই গবাদি পশুকে বাঁচাতে শকুনকে তাড়ানোর দরকার পড়বে না। বরং দুর্ভাগ্যক্রমে গবাদি পশু মরে গেলে শকুন আমাদের উপকারে আসবে।
প্রকৃতিপ্রেমী কবি জীবনানন্দ দাশ আমাদের ভুল দেখাটাকে বড়ো করে দেখেছেন।
"আমরাও নীলিমার শকুনকে দেখি নাই কোনোদিন
তবু তার পরিবর্তে আকাশে হাউই বাজি ছুঁড়ে
সেই অগ্নিচূড়া যতদূর উড়ে যায় দেখিনি কি?"
***লেখাটি ১৪ এপ্রিল ২০২৫ খ্রি. তারিখে সাপ্তাহিক অজানা খবর পত্রিকার বাংলা নববর্ষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। (৩/সম্পাদকীয় পাতার ২য় কলামে (উপরে) ছাপা হয়।)
![]() |
*লেখক-মোঃ ফেরদৌস আলম, সাবেক শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। |
লেখাটি সাজানো গোছানো। কনসেপ্টটিও দারুণ। শেষের দিকে মানুষের শোষণ, নিপীড়নের চিত্র আরও কিছু বাস্তব চিত্র তুলে ধরে প্রকাশ করলে লেখাটি স্বয়ংসম্পূর্ণ হতো বলে মনে করি।
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ, ভাই। আপনার মূল্যবান পরামর্শ পরবর্তী লেখাকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করবে।
মুছুনঅসাধারণ
উত্তরমুছুনঅসংখ্য ধন্যবাদ।
মুছুন