স্বপ্নের করিডোর

Photo Credit: https://www.maxpixel.net/Architecture-Wood-Door-Retro-Home-Wooden-303560

০৮ জানুয়ারি, ২০১৭। রোববার সকাল ৯টা ৪৫ মিনিট। হন্তদন্ত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ভবনের সর্বোচ্চ তলায় (তখন ভবনটি ৬ তলা ছিল) উঠে গেলাম। ৬১৮ নম্বর কক্ষে ৯টা ৪০ মিনিট থেকে ক্লাস! বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম ক্লাসেই দেরি করে ফেললাম! সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের এ ভবনের রাস্তাই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অথচ এমন সোজা রাস্তা! কলা ভবন ও ডাকসু ভবনের মাঝের রাস্তা দিয়ে গেলাম শেষে। এক দৌড়ে ষষ্ঠ তলায়। উদ্ভ্রান্ত লাগছিল। বিভাগের নাম লেখা সিঁড়ির সামনেই। এক ফ্লোরে ২টা বিভাগ। তির চিহ্ন দিয়ে নির্দেশ করা কোনটা কোন দিকে। অবশ্য ভর্তির কাজে এসেছিলাম এখানে। ডান দিকে খুঁজে পেলাম ৬১৮। 

দরজা বন্ধ! আবছা অন্ধকার করিডোর। রহস্যময় লাগছিল। অজানা মাত্রই কি রহস্য? দুদিকের দেয়াল অন্য কক্ষ দিয়ে ঢাকা। শুধু দরজার জায়গাটা ফাঁকা। ভিতরের না কিছু দেখা যায়, না কিছু শোনা যায়। সবাই কি চলে এসেছে? ক্লাস নিশ্চয় শুরু হয়ে গেছে। আমি কি অনেক দেরি করে ফেললাম? ভিতরে যেতে সাহস হচ্ছে না। সাহসের অভাবের সাথে দরজা সংক্রান্ত জ্ঞানের অভাবও ছিল! স্মৃতিও কেমন আবছা অন্ধকারে আচ্ছন্ন!

এরকম দরজা আগে কখনো দেখিনি। কাঠের প্রশস্ত দরজা, কিন্তু শক্ত করে আঁটা। এর আগে কোনো শ্রেণিকক্ষে এরকম দরজা দেখিনি। বেশির ভাগ সময়ই দরজা খোলা থাকত। বড়ো রহস্যময়। স্রেফ দরজার বাইরে এ দরজাকে রহস্যের দুয়ার মনে হচ্ছিল। কত কিছুর দরজা এটা! উচ্চশিক্ষার দরজা। শিক্ষাশ্রেণির বাইরে শ্রেণির ভিন্ন অর্থের ধারণা  পেয়েছি এ দরজার ভিতরে গিয়ে--সামাজিক শ্রেণি। এ দরজা কি শ্রেণি বৈষম্যের আড়াল? দরজা শব্দটি অনেক সময় স্তর বোঝাতেও আমরা ব্যবহার করি। সামাজিক স্তরবিন্যাসেও তো দরজা প্রাসঙ্গিক হতে পারে। শ্রেণিকক্ষের দরজার ওপাশে কি শ্রেণি পরিবর্তনের সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে? শিক্ষার সম্ভাবনা কি আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা পরিবর্তনেরও সুযোগ নয়? উচ্চশিক্ষা তো আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। 

সামাজ বিশ্লেষণে চিহ্নিত হয়েছে প্রোলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বলে এখানে প্রোলেতারিয়েত শ্রেণির আনাগোনা মন্দ নয়। তাদের জন্য কি এ দরজা শ্রেণি পরিবর্তনের সুযোগ নয়? শিক্ষাশ্রেণির পরিবর্তনের সাথে সাথে শ্রেণিকক্ষেরও পরিবর্তন ঘটে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। উচ্চশিক্ষার এ দরজা কি সামাজিক শ্রেণি পরিবর্তনেরও উপলক্ষ নয়? 

সামাজিক শ্রেণি পরিবর্তন আর সমাজ পরিবর্তন এক জিনিস নয়। প্রোলেতারিয়েত থেকে বুর্জোয়া বনে যাওয়া মানুষগুলো অধিকাংশ সময়ই সমাজবিস্মৃত হয়। উচ্চশিক্ষার এ সুযোগ তো সমাজ পরিবর্তনের দ্বার হওয়া উচিত। শুধু প্রোলেতারিয়েত নয়, বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যেও সামাজিক দায়বদ্ধতা তৈরি করার কথা এ শিক্ষার। সামাজিক শ্রেণিবৈষম্য দূর করাই হওয়া উচিত শিক্ষার লক্ষ্য। কিন্তু আলিবাবার মতো চল্লিশ চোরের গুপ্তধনের সন্ধান যারা পায়, তারাই শুধু ধনী হয়। প্রোলিতারিয়েত থেকে হয় বুর্জোয়া। এটুকুতেই আলিবাবার সাথে তাদের মিল। পরবর্তীতে সমাজ পরিবর্তনের কোনো তাগিদ তারা বোধ করে না। শুধু চোরের সংখ্যাই বৃদ্ধি পায়। নামে চল্লিশ চোর হলেও, সংখ্যায় তারা লাখে লাখে হাজারে হাজার! শোষক বুর্জোয়া চল্লিশ চোর রূপে আমাদের সমাজের সমস্ত শ্রম ও অধ্যবসায় শোষণ করে জমা করছে রহস্যময় দরজার আড়ালে। দরজার মন্ত্র হয়ে উঠেছে উচ্চশিক্ষা। আলিবাবার মতো একজন একজন করে শেখে রহস্য দরজার মন্ত্র। একজন কিংবা একটি পরিবার হয়ে ওঠে নতুন বুর্জোয়া। আলিবাবার ভাই কাসিম সওদাগরের মতো কেউ কেউ রহস্য দরজার মন্ত্রও কেড়ে নেয়। অনর্জিত মন্ত্রের বলে বুর্জোয়া গুহায় প্রবেশ করে হয়ে ওঠে উন্মত্ত। লোভ-লালসায় মেতে বুর্জোয়া পরিমণ্ডল থেকে বের হওয়ার মন্ত্র তারা ভুলে যায়। সমাজে তাদের প্রত্যাবর্তন হয় না। সামাজিক শ্রেণি পরিবর্তন হলেও সমাজ পরিবর্তন আর হয় না। 

শোষিত শ্রেণি জানে না চল্লিশ চোরের মন্ত্র। তাদের থেকে লুুট হওয়া রক্ত-ঘাম শোষণের ওপর গড়ে ওঠা সম্পদে তাদের কোনো অধিকার থাকে না। শিক্ষা হয়ে উঠেছে রহস্য দরজার মন্ত্র। শ্রেণি পরিবর্তনের মন্ত্র। পরিবর্তে সমাজের জন্য আসে বড়ো বড়ো দুর্বোধ্য মন্ত্র। প্রোলেতারিয়েত শ্রেণি দুর্বোধ্য মন্ত্রের ইঙ্গিত বোঝে না। উচ্চারণ করতে পারে না রহস্য দরজার মন্ত্র। তাদের দরকার সহজ ও সাধারণ মন্ত্র। ন্যায্য অধিকার। দয়া নয়। শোষণমুক্তি। 

:এই ছেলে, দরজা ঠেলে ভিতরে যাও!

 হঠাৎ চমকে উঠলাম। নোটিশ বোর্ডের ওদিক থেকে নারীকণ্ঠ শুনতে পেলাম। দেয়ালঘেষে রাখা চেয়ারে বসা কালো বোরখা পরিহীতা এক নারী বললেন কথাটি। সম্ভবত আমারই কোনো সতীর্থের মা হবেন। রহস্য দরজার ওপাশে ছেলেমেয়েকে পাঠিয়ে অপেক্ষা করছেন। আমার মতো সাহসের অভাব যাতে না হয়। আমিও সাহস পেলাম। দরজার এক অংশ ঠেলে ভিতরে গেলাম। বিরাট শ্রেণিকক্ষ। অসংখ্য নতুন মুখ! শিক্ষক অবশ্য পরিচিত। টেলিভিশন টকশোতে দেখেছিলাম একবার। বিভাগে ভর্তি হয়ে বাড়ি গিয়ে টকশো আলোচকের নামের সাথে বিভাগের নাম দেখেই আনন্দিত হয়েছিলাম। মাকে ডেকে দেখিয়েছিলাম। ইনি আমাদের পড়াবেন। গর্বের বিষয়! মাকে অবশ্য কোনো দিনই আমার জন্য শ্রেণিকক্ষের বাইরে অপেক্ষা করতে হয়নি। সাহসটুকু মায়ের আঙ্গিনা থেকেই নিয়ে এসেছি। তবে ওই দিনের সাহসটুকু অপরিহার্য হয়ে রইল। মনে রইল অপরিচিতা মায়ের প্রেরণা। 

এই শহরে আশ্রয়ের ঠিক ছিল না। মাথাগোজার জায়গা নির্দিষ্ট না হতেই শ্রেণিকক্ষের দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। শ্রেণিকক্ষে জায়গা হলো অবশেষে। শত মাইল পাড়ি দিয়ে এ দরজার সামনে দাঁড়ালাম। শত সংগ্রাম, সংকল্প ও ভাগ্যের ফের!

অর্ধযুগ পার হয়ে গেছে। এবার বের হওয়ার পালা। দরজার ভিতরের রহস্য উদ্ঘাটিত হলেও বাইরের দুনিয়া এখন আবার রহস্যময় হয়ে উঠেছে। শ্রেণি পরিবর্তনের শিক্ষা কিছুটা হয়েছে। সমাজ পরিবর্তনের ইঙ্গিতও পেয়েছি কিছুটা। কিন্তু বাঁচার তাগিদ সবচেয়ে বড়ো হয়ে উঠেছে। পরিবার, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা--এসব কিছুই উচ্চাভিলাসী স্বপ্ন মনে হচ্ছে। অর্ধযুগ পর দরজার বাইরে এসেও মনে হচ্ছে প্রথম দিনের আবছা অন্ধকার আজও জুড়ে আছে স্বপ্নের করিডোর। শ্রেণিকক্ষের ভিতরের রেশ বাইরের প্রতিবেশে কতটুকু থাকে, দেখা যাক।

*লেখক-মোঃ ফেরদৌস আলম, 
সাবেক শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

জেরুজালেমের নবি যেরেমিয়া ও জলবায়ু সতর্কতা

শকুন ও সংস্কৃতির দ্বন্দ্ববিচার

একটি জাতীয়তাবাদী নাটিকা : বাংলা ও বালআমের গাধা