সদরঘাট থেকে ফতুল্লা, একজন সহযাত্রী ও আমার বিবেচনা
২৪ জুন, ২০২৩ (রাত ৮-১০টা, সুন্দরবন-১২):
কুরবানির ইদের বাকি পাঁচদিন মাত্র। বাড়ি যাওয়ার জন্য পুরান ঢাকার জনজোয়ারে ভেসে সদরঘাট এসেছি। মাগরিবের নামাজের জামাত শেষ হয়েছে। টার্মিনালের দ্বিতীয় তলার মসজিদে প্রশান্তির অজু করে নামাজ পড়লাম। এবার লঞ্চের খোঁজ করা যাক। পন্টুনে গিয়ে সুন্দরবন-১২ (ঢাকা-ফতুল্লা-চাঁদপুর-চরমোনাই-বরিশাল-দপদপিয়া-নলছিটি-ঝালকাঠি) লঞ্চে উঠে পড়লাম। ইদ উপলক্ষ্যে চিরচেনা রূপে ফিরেছে সদরঘাট। জমজমাট হয়ে উঠেছে লঞ্চযাত্রা। মোটামুটি ভিড় দেখে লঞ্চের দ্বিতীয় তলায় সামনের খোলা অংশে আসন নিলাম। আশেপাশে আরও দু-চারজন আছেন। সামনের দিকটায় প্রচণ্ড বাতাস। এক বয়োজ্যেষ্ঠ লোক অনেক ইতস্তত করে নিচ তলায় নেমে গেলেন। বরিশালের যাত্রী অনেক। পাশের দুই উচ্চমাধ্যমিক পড়ুয়া ছেলের সাথে পরিচিত হলাম। এরপর এলেন আরেক বয়োজ্যেষ্ঠ লোক। আগের জনের চেয়ে কম বয়স। দুইজন সঙ্গী। একজন সম্ভবত তার ছেলে হবেন। বাবা-ছেলে দুজনই পাঞ্জাবি-টুপি পরা। অনেকগুলো কাগজের ঠোঙা সাথে। তারা নেমে যাওয়ার সময় দেখতে পেলাম সেগুলো ভর্তি আম। বয়স্ক লোকটি নামাজের জন্য কার্পেট ও জায়নামাজ বিছানোর ব্যবস্থা করলেন। প্রথমে মনে হলো এগুলো তিনি সাথেই নিয়ে এসেছেন। পরে অবশ্য দেখলাম এগুলো লঞ্চেরই ব্যবস্থা। তিনি লঞ্চস্টাফদের বলে বিছানোর ব্যবস্থা করেছেন। তার ছেলের ইমামতিতে আমরা মোটামুটি আকারের জামাতে নামাজ আদায় করলাম। আমরা নামাজ শেষ করার পরও বয়স্ক লোকটি সুন্নত ও বিতরের নামাজ আদায় করছিলেন। সবাই উঠে যাওয়ায় কার্পেট বাতাসে ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছিল। আমি আবার কার্পেট চাপিয়ে রাখতে এক কোনায় বসে পড়লাম। নামাজ শেষে তিনি জাজাকাল্লাহ (আল্লাহ তোমাকে প্রতিদান দিবেন) বলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন।
যাহোক, প্রাথমিক আলাপে ফিরে যাই। আমার চাদর গুছিয়ে কার্পেট বিছানোর সময় বয়োজ্যেষ্ঠ লোকটির সাথে প্রথম কথা হয়। কার্পেট বিছিয়ে বসে জিজ্ঞেস করলেন আলিয়া মাদরাসায় পড়েছি কিনা বা এখনও পড়ছি কিনা। আমি বললাম পড়াশোনা শেষ আপাতত। ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স শেষ করেছি মাত্র। জিজ্ঞেস করলেন, কোন ইউনিভার্সিটি? আমি বললাম, ঢাকা ইউনিভার্সিটি। সাথে বললাম, আলিয়া মাদরাসায় পড়েছি দাখিল (এসএসসি) পর্যন্ত। তিনি বললেন, ওই হলো। তারপর দ্বিনি ও দুনিয়াবি পড়াশোনার সমন্বয় পেয়ে তিনি তার বিশ্বাসের পাল্লায় আমার বিশ্বাস মাপতে শুরু করলেন। একের পর এক প্রশ্ন করে গেলেন। প্রশ্ন করার ধরন চমকপ্রদ। চটপটে। মনে হচ্ছে জানাশোনা ভালোই।
জিজ্ঞেস করলেন, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে তোমার কী মত? অর্থাৎ, সংবিধানে উল্লিখিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসমূহ চটপট বলে গেলেন। ইসলামের দৃষ্টিতে এগুলো কী?
আমি যেহেতু সামাজিক বিজ্ঞানের ছাত্র, সেহেতু এসব আমার কাছে দ্ব্যর্থবোধক। আমি গণতন্ত্র ব্যাখ্যা করতে শুরু করলাম। বললাম, গণতন্ত্রের অনেক রূপভেদ আছে। কোনটাকে বিবেচনায় নিবেন? তাছাড়া নির্বাচন পদ্ধতি সম্পর্কে ইসলামের ইতিহাস বৈচিত্র্যপূর্ণ। খোলাফায়ে রাশেদিনের সময়কালের অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থার কথাও বলতে শুরু করলাম।
মুরুব্বি আমাকে থামিয়ে দিলেন। উর্দুতে বললেন, লম্বা কথা বলার দরকার নেই। এক কথায় জানতে চাইলেন যে, গণতন্ত্র কুফুরি ব্যবস্থা কিনা।
আমি বললাম, এক কথায় বলা তো ঠিক হবে না। আমি যা বলেছি তাতে আপনিই বিবেচনা করুন। তার মতাদর্শ কিছুটা ধরতে পেরে বললাম, গণতন্ত্রে “জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস” এটা সমস্যা?
তিনি আর বলতে দিলেন না। উর্দুতে বলে গেলেন, হা, হা, সব কুফুরি, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্ম নিরপেক্ষতা।
আমি আর তর্কে গেলাম না। মনে মনে বললাম, “প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ” আব্রাহাম লিঙ্কনের সংজ্ঞা মতে এ তো সাধারণ কথাই।
মুরুব্বি এরপর বললেন, সব কুফুরি। বিচার কুফুরি! বাংলাদেশের বিচারপতিরা সব কাফের মুরতাদ!
এবার আমি তার অবস্থান বুঝতে পারলাম। বললাম, এগুলো তো খারিজিদের মতবাদ।
তিনি খারিজিদের মতোই বললেন, আল্লাহর বিচার ছাড়া কোনো বিচার নাই। (কুরআনের আয়াতের ভিন্ন ব্যাখ্যা।)
আমি তাকে বললাম, খারিজিরা এই মতবাদের ভিত্তিতেই সাহাবিদের কাফের সাব্যস্ত করেছিল। হজরত আলি (রা:) কে কাফের ফতোয়া দিয়ে হত্যা করে তারা।
মুরুব্বি আর শুনতে চাচ্ছিলেন না।
(বাংলাদেশেও ২০০৫ সালে সিরিজ বোমা হামলার সাথে এই মতবাদের যোগাযোগ ছিল বলে মনে করা হয়। জেএমবি’র মতাদর্শেও বিচারকরা সব কাফের। যেহেতু আল্লাহর বিচার ছাড়া কোনো বিচার নেই, সেহেতু বিচারকরা সব কাফের। তাদেরকে হত্যা করা বৈধ মনে করে তারা তাদেরকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে।
আমার সহজ সরল ছোট্ট সহপাঠি সজিবের বাবা বিচারক ছিলেন না। তিনি ছিলেন গাড়িচালক। বিচারকদের গাড়ি চালক। খুব কাছ থেকে তিনি তখন বেঁচে গেলেও যে বিভীষিকার শিকার হয়েছিলেন তা আমাদেরকেও ব্যথিত করেছিল। সজিবের খবর আর জানি না। তৃতীয় শ্রেণির পর ওর পড়াশোনা চলেছিল কিনা তাও জানি না। আল্লাহ সজিবের ভালো করুন।)
আমি যখন আমার মতের পক্ষে যুক্তি দেখাচ্ছি, তখন মুরুব্বি বললেন, “নকরি কা লিয়ে তুম ইয়ে বাতা থা” (সরকারি চাকরির জন্য তুমি এসব বলতেছ)! তোমার ইমান যায় যায় অবস্থা। অল্প একটু আছে!
বাড়িতে ধর্ম নিয়ে ছোটোখাটো তর্কে দাদি বলেছিলেন, ভার্সিটিতে পড়ে তোর এই অবস্থা! ইমান যায় যায় আর কি! অথচ ধর্ম কর্ম আমার ভার্সিটির পাঠ্য না। আমার মতাদর্শ গড়ে উঠেছে সেই মাদ্রাসা থেকেই। আমার আদর্শিক গুরু ঝালকাঠির কায়েদ সাহেব (র:)। তার লেখা ‘আকায়েদ’ (বিশ্বাসমালা) বই থেকে চরমপন্থা, শিথিলপন্থা ও মধ্যমপন্থা সম্পর্কে জেনেছি। জেনেছি যে, যুগ যুগ ধরে চরমপন্থিদের মতাদর্শে ঐকতান রয়েছে। ভুল কাজের চেয়ে ভুল বিশ্বাস মানবজাতির জন্য বেশি ক্ষতিকর।
তো মুরুব্বিকে বললাম, আমার ও আমার পাশের ছেলেটির মধ্যে ঝগড়া হলে আপনি কি মিমাংসা করবেন না? এ বিচার কি জায়েজ নয়? আল্লাহ কি আমাদের বিবেক দেননি? বিবেককে কাজে লাগানো কি আমাদের কর্তব্য নয়? কুরআনের মূলনীতি আমরা অনুসরণ করব ঠিক, কিন্তু বিবেককে কাজে লাগানোও তো কুরআনের হুকুম।
এ সম্বন্ধে হজরত আবু হানিফা (র:) ও একজন খারিজি ব্যক্তির তর্ক উল্লেখযোগ্য। (মুরুব্বিকে বলার অবশ্য সুযোগ পাইনি!)
উমাইয়া শাসনামলে বিদ্রোহকারী আদ-দাহাক ইবনে কায়েস আল খারিজি কুফার মসজিদে প্রবেশ করে আবু হানিফাকে বললেন, তওবা করো। আবু হানিফা জিজ্ঞেস করলেন, কীসের জন্য? খারিজি ব্যক্তি বলল, শালিসের অনুমোদন দেয়ার জন্য। আবু হানিফা বললেন, তুমি কি আমাকে হত্যা করবে, নাকি আমার সাথে আলোচনা করবে? সে বলল, আমি তোমার সাথে আলোচনাই করবো। আবু হানিফা বললেন, আলোচনায় কোনো বিষয়ে আমাদের যদি মতানৈক্য হয়? তাহলে আমাদের মধ্যে সিদ্ধান্ত দিবে কে? সে উত্তর দিলো, তুমি যাকে নিয়োগ দিবে তাকেই আমি মেনে নিবো। আবু হানিফা দাহাকের একজন সঙ্গীকে বললেন, বসো এবং আমাদের মধ্যে বিচার করো যদি আমাদের মতানৈক্য হয়। তারপর আবু হানিফা আদ-দাহাকের দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি আমাদের মধ্যে সিদ্ধান্তের জন্য এর ব্যাপারে সন্তুষ্ট? সে হ্যাঁ-সূচক সম্মতি দিলো। আবু হানিফা বললেন, তাহলেই তুমি শালিসের অনুমোদন দিলে। সুতরাং ক্ষান্ত হও। (“ইমাম আবু হানিফা: তার জীবন, মত ও ফিকহ”, লেখক: মুহাম্মাদ আবু জাহরা, মাকতাবাহ প্রকাশন, ১৯৪৫)
যাহোক, কিন্তু মুরুব্বি তর্কেও আসলেন না। বললেন, আমার কথা আমি বললাম। তুমি মানলে মানো, নইলে না। আমি বললাম, আমিও আমার কথা বললাম। এশার নামাজ পড়লাম। এরপর নতুন করে আর তর্কে গেলাম না। মুরুব্বি লোক যেহেতু ফতোয়া দিয়েই ক্ষান্ত অর্থাৎ, তর্ক কিংবা হত্যা কোনোটাতেই আগ্রহী নন, তখন কবির ভাষায় বলতে হয়,
“আপনার কাছ থেকে কোনো উপহার আশা করি না
শুধু ক্ষতি করবেন না এই প্রতিশ্রুতি ছাড়া।”
“যে কোনো স্বেচ্ছাচারী ব্যক্তিকে উপদেশ দিতে যায়,
উপদেশ তার নিজেরই বেশি দরকার হয়।”
সুতরাং শান্তির পথই বেছে নিলাম। শেষে জিজ্ঞেস করলাম, মুরুব্বি, আপনারা কোথাকার লোক? সদরঘাট (পুরান ঢাকার) নাকি ফতুল্লা (নারায়নগঞ্জের)? উত্তরে মুরুব্বি বললেন, বেটা, মেয়র আইভি কা নাম সুনা? হাম উস গলিকা লোক! (বৎস, মেয়র আইভির নাম শুনেছ? আমরা তার এলাকার লোক!)
এবার জসীম উদ্দীনের “মেনা শেখ” কবিতার কথা মনে পড়ে গেল,
“সাত গাঁর লোক গর্ব করে ফুলিয়ে বুকের ছাতা,
মেনা শেখের গাঁয়ের মানুষ নইকো মোরা যাতা।” (রাখালী, ১৯২৭)
সরকার, রাজনীতি, বিচার ব্যবস্থা সবকিছুতে অসন্তুষ্ট হলেও মুরুব্বি মেয়র আইভির গলির লোক বলে গর্বিত মনে হলো। ফতুল্লা ঘাট চলে এলো এক ঘণ্টার কম সময়ে। মুরুব্বি সাথের দু’জন সহ নেমে গেলেন।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে সরল সঠিক পথ দেখান।
***হিন্দি/উর্দু কিছুটা বুঝতে পারি কিন্তু বলতে কিংবা পড়তে-লিখতে দক্ষ নই। সুতরাং, মুরুব্বির উর্দু উদ্ধৃতি অল্পই উল্লেখ করা হয়েছে। ভুলগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
***সরকার, রাজনীতি, বিচার ব্যবস্থা ইত্যাদির সাফাই গাওয়া আমার মতাদর্শের উদ্দেশ্য না। কুরআন বর্ণিত সরল পথের সন্ধানই আলোচনার উদ্দেশ্য।
![]() |
*লেখক-মোঃ ফেরদৌস আলম, সাবেক শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। |
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন