অসহায় দিল্লি ও আবেগের ইতিহাস (২০২০)

Photo credit: https://historicaltimeofindia.blogspot.com

ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন-কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাণহানীর সংখ্যা বাড়ছে। সর্বশেষ দিল্লির পরিস্থিতি যথেষ্ট উদ্বেগের। ভারতে ক্ষমতাসীনদের হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনের জেরে একের পর এক ঘটনা ঘটে চলেছে। বাবরী মসজিদ নিয়ে গেরুয়া রাজনীতির অনেক হলো। এরপর চলমান আন্দোলনের মুখে দেশটিতে মুসলিমদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করা স্বাভাবিক। এ ব্যাপারে মন্তব্য করার জন্য একটু ইতিহাস পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।

ভারতে মুসলিমরা রাজা ও প্রজা দুই অবস্থাতেই ছিল। মুসলিম শাসনের অবসানে ব্রিটিশ আমলে 'Divide and Rule' নীতির কারণে হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক ভিন্ন রূপ পায় 'জালিয়ানওয়ালায় যে পথের শুরু'। আহমদ ছফা তার এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, '...উপমহাদেশে যত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা রয়েছে তার শতকরা আশিভাগ দুটি মূল বিষয়কে কেন্দ্র করে ঘটেছে। একটি হলো গরু জবাই এবং অন্যটি মসজিদের সামনে বাজনা বাজানো।' আমার নিজ জেলা ঝালকাঠিতে কুলকাঠি গণহত্যা হিসেবে পরিচিত ১৯২৭ সালের এক ঘটনায় একটি মসজিদের সম্মান রক্ষার্থে গুর্খা পুলিশের গুলিতে নিহত হন ১৯ জন মুসলমান। যাহোক, আহমদ ছফা উল্লেখিত কারণ দুইটি বর্তমানেও ক্রিয়াশীল। ভারতে গরু জবাই নিয়ে মুসলিমদের অসহায় অবস্থা আজও উদ্বেগজনক। তবে মসজিদের সামনে বাজনা বাজানো নিয়ে এখন আর উপমহাদেশে বিধর্মীদের সাথে হাঙ্গামা হওয়ার ঘটনা নেই বললেই চলে। বরং মসজিদের কাছাকাছি, ঈদের সময়, নামাজের সময় মুসলিমরাই বাজনা বাজিয়ে চলেছে। যাক সে কথা। এখন বোধকরি ভারতে ব্রিটিশদের সেই নীতি ভিন্ন রূপ পেয়েছে 'Rule and Divide'!
সমূহ কারণে ব্রিটিশ আমলে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক তিক্ত হয়। আমি 'আবেগের ইতিহাস' বলতে সাহিত্যে এর নজির খোঁজার চেষ্টা করছি। আজ যে ভিত্তির উপর ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন কিংবা হিন্দুত্ববাদের আগ্রাসন চলছে তার শিকড় সাহিত্যেই বেশি পাওয়া যাবে। সাহিত্য আর রাজনীতি গলাগলি ধরে চলেছে ব্রিটিশ ভারতে। বঙ্কিমচন্দ্র তার বিকৃত ইতিহাসবোধ দিয়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ফকিরদের ভূমিকা বাদ দিয়ে সন্ন্যাসীদের নিয়ে এক আকাশ কুসুম আনন্দমঠের স্বপ্নে বিভোর ছিলেন।
'বঙ্কিমের বিরুদ্ধে একটি সাধারণ অভিযোগ হলো তিনি ইতিহাসকে বিকৃত করেছেন-কথাটা সত্যি।..বঙ্কিম সানন্দে যে অন্ধকার ছড়িয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো একজন ব্যক্তিত্বের জীবনভর সংগ্রাম তা দূর করতে পারেনি পুরোপুরি' (আহমদ ছফা)।
হিন্দু-মুসলিম সাহিত্যিকরা অনেকেই তিক্ত সম্পর্ককে মধুর না হোক অন্তত পানির মতো স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছেন পরবর্তী সময়ে, বিশেষ করে অবিভক্ত বাংলায়। জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন,
'হে ভাই মুসলমান
তোমাদের তরে কোল পেতে আছে ভারতের ভগবান!'
কাজী নজরুল ইসলাম এর লেখা এ সময়ে সমাজ ও রাজনীতিকেও প্রভাবিত করেছে।
আবেগের ইতিহাস রেখে বর্তমানে ফিরে আসতে হচ্ছে। আহমদ ছফার উল্লেখিত দাঙ্গা নয়, দুটি কারণও নয়। আজ ভারতে রক্ত ঝরছে বঙ্কিম সাহিত্যে প্রোত্থিত সেই আবেগে। যাহোক, লাহোর প্রস্তাবে যা ছিল, দেশ ভাগ আর দ্বিজাতি তত্ত্ব তিন ভিন্ন প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় এ কে ফজলুল হক উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাব আক্ষরিক অর্থে আমলে নেয়া হয়নি। অন্যদিকে, হিন্দু-মুসলিম দুই জাতিকে আলাদা করাও সম্ভব হয়নি। ভারতে থেকে যান উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিম, পাকিস্তানেও হিন্দু। আর অন্য ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীগুলোর অবস্থার বিশ্লেষণ আমার সাধ্যের বাইরে। দেশ ভাগের ফলে অনেক মুসলিম কলকাতা ছেড়ে ঢাকায়, দিল্লি ছেড়ে লাহোর এসেছেন। আবার পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন অনেক হিন্দু। তবে হিন্দু-মুসলিম শরণার্থীদের সংখ্যা ভারত-পাকিস্তানের হিন্দু-মুসলিম সংখ্যার অনুপাতে কম ছিল। আজ যদি নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্নই ওঠে তবে সেদিন কলকাতা ছেড়ে ঢাকা আসা মুসলিমদের বা বরিশাল-খুলনা ছেড়ে কলকাতা যাওয়া হিন্দুদের নিয়ে উঠতে পারত, যদিও তা আদান-প্রদানের হাঙ্গামা ছাড়া আর কিছুই বয়ে আনবে না। হাসান আজিজুল হকের 'আগুন পাখি' শরণার্থীদের (বিশেষ করে বাংলার) সেরকম বার্তাই দেয়। সেক্ষেত্রে ভারতের বর্তমান আলোচিত আইনটি পুরোপুরি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সে সব ছলাকলা ব্যর্থ হোক, আসামের নাগরিকপঞ্জি অনেকটা সেরকম বার্তাই দিয়েছে।
দিল্লি আজ অসহায়। কিন্তু দিল্লির মসনদে মুসলিম শাসকদের কীর্তি আজও ভারতের গৌরব ঘোষণা করে। ভারত বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানদের সামনে আজও তাই তুলে ধরে, কিন্তু হায়, মুসলিমদের তারা ছুড়ে ফেলতে চায়! রবীন্দ্রনাথ শা-জাহানকে স্মরণ করেছেন,
'চলে গেছ তুমি আজ,
মহারাজ—
রাজ্য তব স্বপ্নসম গেছে ছুটে,
সিংহাসন গেছে টুটে,
তব সৈন্যদল
যাদের চরণভরে ধরণী করিত টলমল
তাহাদের স্মৃতি আজ বায়ুভরে
উড়ে যায় দিল্লির পথের ধূলি-‘পরে।'
আজ গভীর দু:খ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ভারতের নিদারুণ ব্যর্থতা দেখে ব্যর্থ পাকিস্তানের তীর্থ বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের প্রতি সুকান্তের বাণীই স্মরণ করতে হচ্ছে, “শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।”

*লেখক-মোঃ ফেরদৌস আলম, 
সাবেক শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

জেরুজালেমের নবি যেরেমিয়া ও জলবায়ু সতর্কতা

শকুন ও সংস্কৃতির দ্বন্দ্ববিচার

একটি জাতীয়তাবাদী নাটিকা : বাংলা ও বালআমের গাধা